বাংলাদেশে ব্যবসা কমিয়ে আনছে আদানি
বাংলাদেশে ব্যবসা কমিয়ে আনছে আদানি
ডেস্ক রিপোর্ট
08:13:00 | 2024-11-08
ভারতের শীর্ষ ব্যবসায়ী আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা কমিয়ে আনছে। গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদানি বাংলাদেশ পোর্টস প্রাইভেট লিমিটেড সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে। এরই মধ্যে কম্পানিটি বাংলাদেশে কার্যক্রম বন্ধ করতে অবসায়কও নিয়োগ দিয়েছে। কম্পানিটির পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
গত ১৫ অক্টোবর আদানি বাংলাদেশ পোর্টস প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান সন্দ্বীপ মেহতা জানান, তাঁরা কম্পানি আইন অনুযায়ী স্বেচ্ছায় কম্পানিটি অবসায়নের মাধ্যমে সমাধানের পথে হাঁটছেন। গত ৮ অক্টোবর পর্ষদের বিশেষ সাধারণ সভায় কম্পানিটি বন্ধের জন্য অবসায়ক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই সভায় মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে (এফসিএ) অবসায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন থেকে কম্পানির যেকোনো বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ওই অবসায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
জানা যায়, আদানি বাংলাদেশ পোর্টস প্রাইভেট লিমিটেড বন্ধের জন্য এখন অবসায়ক আর্থিক সব হিসাব পর্যালোচনা করে পরবর্তী বিশেষ সাধারণ সভায় উপস্থাপনের পর কম্পানিটি পুরোপুরি বন্ধের পথে হাঁটবে। এই কম্পানি বন্ধের কারণ জানতে চেয়ে আদানি গ্রুপের করপোরেট কমিউনিকেশন কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়ে ই-ইমেইল করা হলেও সাত দিনে তিনি কোনো জবাব দেননি।
ভারতীয় কম্পানি আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০২০ সালের মার্চ মাসে আদানি বাংলাদেশ পোর্টস প্রাইভেট লিমিটেড নামে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। বন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে এই কম্পানি নিবন্ধিত হয় যৌথ মূলধন কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে।
ভারতের আদানি পোর্টস বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ ও ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কম্পানি। এই কম্পানির সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদানি বাংলাদেশ পোর্টস।
সূত্রে আরো জানা যায়, আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে সরবরাহ করা বিদ্যুতের পাওনা টাকা দীর্ঘদিন দাবি করে এলেও এখন পর্যন্ত পায়নি। এই পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে সরে যাচ্ছে। নতুন এই কম্পানি বন্ধ করা হলেও ভারতীয় মূল কম্পানি আদানি পোর্টস অ্যান্ড এসইজেডের একটি শাখার মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের অন্য ব্যবসা অব্যাহত রাখবে।
আদানি বাংলাদেশ পোর্টস প্রাইভেট লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ অর্থবছরে (৩১ মার্চ পর্যন্ত) কম্পানির সম্পদের পরিমাণ ছয় কোটি ৭৭ লাখ পাঁচ হাজার ৮৬৬ টাকা। এই অর্থবছরে কোনো আয় করেনি কম্পানিটি, উল্টো ছয় লাখ ৯০ হাজার ৮৮৯ টাকা লোকসান দিয়েছে।
২০২৩ সালের ৩১ মার্চ কম্পানির অংশীদারদের স্বত্বের (ইকুইটি) পরিমাণ দাঁড়ায় ছয় কোটি ৭৮ লাখ ৪৭ হাজার ২৮১ টাকা। ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ শেষে ইকুইটির পরিমাণ কমে ছয় কোটি ৭১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯২ টাকা হয়েছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে আদানি গ্রুপের কর্ণধার ভারতের শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির পুত্র ও আদানি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা করণ আদানি জানিয়েছিলেন, আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা দেখছে। সে জন্য এ দেশের পোর্টসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নে বিনিয়োগে নজর দিয়েছেন তাঁরা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ভারতের শীর্ষ ধনকুবের ও আলোচিত ব্যক্তি গৌতম আদানির রয়েছে নানা ধরনের ব্যবসা। সম্পদের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিঙ্গাপুরের উইলমার ইন্টারন্যাশনাল ও আদানি গ্রুপের যৌথ কম্পানি বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (বিইওএল) ১৯৯৩ সালে যাত্রা শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশে ব্যবসা করছে। কম্পানিটির রূপচাঁদা, ফরচুন, কিংস, মিজান ও ভিওলা ব্র্যান্ড নামের ভোজ্য তেল বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এরপর পর্যায়ক্রমে খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত নানা খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে গ্রুপটি। গত কয়েক বছরে আরো অনেক খাতে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করেছিল। এখন কম্পানিটির অন্য খাতে ব্যবসা চালু থাকলেও পোর্ট ও অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের বিনিয়োগ আপাতত থমকে যাচ্ছে।
মিরসরাইয়ে ৯০০ একর জমিতে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল (আইইজেড), টার্মিনালসহ বেশ কিছু খাতে আদানির বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে কম্পানিটি চালু করা হয়। কম্পানির ভারতীয় ইজেড উন্নয়ন করার পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে ভারতীয় বিভিন্ন কম্পানির বিনিয়োগ করার কথা ছিল। এ ছাড়া এই শিল্পনগরে ভোজ্য তেলসহ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে খাবার তৈরির একটি শিল্প পার্ক করার পরিকল্পনা নিয়েছিল আদানি গ্রুপ। ২০২০ সালে এর জন্য পৃথক ১০০ একর জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়। আদানি ও উইলমারের যৌথ বিনিয়োগে ওই জমিতে নতুন এই কম্পানির মাধ্যমে শিল্প স্থাপনের জন্য উন্নয়নের কাজ করার পরিকল্পনা ছিল।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে ডেভেলপার হিসেবে নিয়োগের জন্য আদানি গ্রুপের সঙ্গে বেজার চুক্তির শর্তাবলি (টার্মশিট) সই হয়েছে। এরপর দ্রুত কাজ করতে নতুন ওই কম্পানি চালু করা হয়। কম্পানি এরই মধ্যে বেজার অন্য একটি প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষ করেছে। এই প্রকল্পের কাজসহ নানা উন্নয়নকাজ করতে ৫৬ হাজার ৬৪০ ডলারের ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, জাহাজ, নৌকা ও ভাসমান কাঠামো, হালকা যান, ফায়ার ফ্লোট, ড্রেজার, ভাসমান ক্রেনসহ নানা যন্ত্রপাতি আমদানি করে আদানি বাংলাদেশ পোর্টস। পাশাপাশি আইইজেড উন্নয়নের বিষয়ে কম্পানিটির সঙ্গে দর-কষাকষি হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে কম্পানিটির সঙ্গে চুক্তি (ডেভেলপমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট) সই করার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। ওই অবস্থার পরে এখন দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে চুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি নেই।
আদানি সূত্রে জানা যায়, নতুন ওই কম্পানি বন্ধ হলেও ভারতের আদানি পোর্টসের বাংলাদেশে যে শাখা আছে তার মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করবে। যে কাজ এখন বাংলাদেশে হচ্ছে তার জন্য দুটি কম্পানির প্রয়োজন নেই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আদানি চলে গেলে তার পরিবর্তে অন্য কেউ উন্নয়ন করবে। এ বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করে ঠিক করা হবে। দেশটির সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। তাদের আগ্রহের ওপর ডেভেলপার নিয়োগ এবং এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন নির্ভর করবে। এই ডেভেলপার কাজ না করলে কার মাধ্যমে উন্নয়ন করবে তার প্রস্তাব ভারত দেবে। এর পরই বেজা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’
এ দেশে বিদ্যুৎ খাতে ব্যবসা বাড়িয়েছে আদানি গ্রুপ। ২০১৭ সালে করা চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত আদানি গ্রুপের এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত পুরো বিদ্যুৎ আগামী ২৫ বছর কিনবে বাংলাদেশ। এই বিদ্যুতের পাওনা নিয়ে টানাপড়েন চলছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল আদানি গ্রুপ। ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে এই প্রস্তাব দেয় আদানি। ওই প্রস্তাবে চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা, পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনা এবং লালদিয়ায় টার্মিনাল স্থাপন ও পরিচালনার কথা ছিল। তবে পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনায় বিনিয়োগ করার অনুমতি পায়নি আদানি কম্পানি। এ ছাড়া বে টার্মিনালের বিষয়েও আদানি গ্রুপকে কিছু জানায়নি আওয়ামী লীগ সরকার।